• Latest post

    ইমাম বুখারি (রঃ) এর জীবনি, বুখারি (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনি,

    ইমাম বুখারী (রঃ)
    নামঃ  মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল। কুনিয়াতঃ আবূ আবদুল্লাহ। লকবঃ শায়খুল ইসলাম ও আমীরুল মু’ মিনীন ফীল হাদিস।
    বংশ পরিচয়ঃ  মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল ইবন ইবব্রাহীম ইবন মুগীরা ইবন বারদিযবাহ, আল জু’ফী আল বুখারী (রঃ)। ইমাম বুখারী (রঃ) এর ঊর্ধ্বতন পুরুষ বারদিযবাহ ছিলেন অগ্নিপূজক। বারদিযবাহ শব্দটি ফারসি। এর অর্থ কৃষক। তার পুত্র মুগীরা বুখারার গভর্নর ইয়ামান আল জু’ফি এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এজন্য ইমাম বুখারীকে আল জু’ফী আর বুখারার অধিবাসী হিসেবে বুখারী বলা হয়।

    ইমাম বুখারীর প্রপিতামহও মুগীরা এবং পিতামহ ইবরাহীম সম্বন্ধে ইতিহাসে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। অবশ্য জানা যায় যে, তার পিতা ইসমা’ঈল (রঃ) একজন মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ ব্যাক্তি ছিলেন। ইমামা মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়েদ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রঃ) প্রমূখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনো হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেননি। তার জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তার আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।

    জন্ম ও মৃত্যুঃ  ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওআল জুমু’আর দিন সালাতের কিছু পরে বুখারায় জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল শনিবার ঈদের রাতে ইশার সালাতের সময় সমরকন্দের নিকট খারতাংগ পল্লীতে ইনতিকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম বাষট্টি বছর। খারতাংগ পল্লীতেই তাঁকে দাফন করা হয়।

    ইমাম বুখারী (রঃ)-এর শিশু কালেই পিতা ইসমাইল (রঃ)ইনতিকাল করেন। তার মাতা ছিলেন পরহেজগার ও বুদ্ধিমতী। স্বামীর রেখে যাওয়া বিরাট ধনসম্পত্তির দ্বারা তিনি তার দুই পুত্র আহামদ ও মুহাম্মাদকে লালন-পালন করতে থাকেন। শৈশবে রোগে আক্রান্ত হলে মুহাম্মাদের চোখ নষ্ট হয়ে যায়, অনেক চিকিৎসা করে ও যখন তার দৃষ্টিশক্তি কিছুতেই ফিরে এল না, তখন তার মা আল্লাহ্‌র দরবারে খুব কান্নাকতি র দু’আ করতে থাকেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, এক বুযুর্গ ব্যাক্তি তাঁকে এই বলে সান্তনা দিচ্ছেন যে, তোমার কান্নাকাটির ফলে আল্লাহ তা’আলা তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।  সপ্নেই তিনি জানতে পারলেন সেই বুযুর্গ হজরত ইব্রাহীম (আঃ)। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন যে, সত্যিই তার পুত্রের চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে। বিস্ময় আর আনন্দে তিনি আল্লাহ্‌র দরবারে দু’রাকাত শোকরানা সালাত আদায় করেন।*

    পাঁচ বছর বয়সেই মুহাম্মাদকে বুখারার এক প্রাথমিক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়া হয়। মুহাম্মাদ বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করে ফেলেন এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বুখারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম দাখিলী (রঃ)-এর হাদিস শিক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। সে যুগের নিয়মানুসারে তার সহপাঠীরা খাতা কলম নিয়ে উস্তাদ থেকে শ্রুত হাদীস লিখে নিতেন, কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) খাতা কলম কিছুই সঙ্গে নিতেন না। তিনি মনোযোগের সাথে উস্তাদের বর্ণিত হাদীস শুনতেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বয়সে সকলের থেকে ছোট ছিলেন। সহপাঠীরা তাঁকে এই বলে ভৎসনা করত যে, খাতা কলম ছাড়া তুমি অনর্থক কেন এসে বস? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেনঃ তোমাদের লিখিত খাতা নিয়ে এস। এতদিন তোমরা যা লিখেছ তা আমি মুখস্থ শুনিয়ে দেই। কথামতো তারা খাতা নিয়ে বসল আর এত দিন শ্রুত কয়েক হাজার হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ) হুবহু ধারাবাহিক শুনিয়ে দিলেন। কথাও কোন ভুল করলেন না। বরং তাঁদের লেখার ভূল-ত্রুতি হয়েছিল, তারা তা সংশোধন করে নিল। বিস্ময়ে তারও হতবাক হয়ে গেল। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারী (রঃ) এর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

    ষোল বছর বয়সে ইমাম বুখারী (রঃ) বুখারা ও তার আশপাশের শহরের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ থেকে বর্ণিত প্রায় সকল হাদীস মুখস্থ করে নেন। সেই সাথে মুসলিম বিশ্বের খ্যাতিমান মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনুল-মুবারক ও ওয়াকী ইবনুল-জাররাহ (রঃ)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ মুখস্থ করে ফেলেন। এরপর তিনি মা ও বড় ভাই আহম্মদের সাথে হজ্জে গমন করেন। হজ্জ শেষে বড় ভাই ও মা ফিরে আসেন। ইমাম বুখারী (রঃ) মক্কা মুকাররামা ও মদীনা তাইয়্যেবাহ কয়েক বছর অবস্থান করে উভয় স্থানের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করতে থাকেন। এই সময় তিনি ‘কাযায়াস-সাহাবা ওয়াত-তাবিঈন’ শীর্ষক তাঁর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতে ‘তারীখে কবীর’ লিখে।।

    ইমাম বুখারী (রঃ)হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র কূফা, বসরা, বাগদাদ, সিরিয়া, মিসর, খুরাসান প্রভৃতি শহরে বার বার সফর করেন। সেই সকল স্থানের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের থেকে তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করেন। আর অন্যদের তিনি হাদীস  শিক্ষাদান করতে থাকেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ রচনায়ও ব্যাপৃত থাকেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘জামি’ সহীহ বুখারী  শরীফ সর্বপ্রথম মক্কা মুকাররামায় মসজিদে হারামে প্রণয়ন শুরু করেন এবং দীর্ঘ ষোল বছর সময়ে এই বিরাট বিশুদ্ধ গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম বুখারী (রঃ) অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন যে, একলাখ সহীহ ও দুইলাখ গায়ের সহীহ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাঁর এই অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির খ্যাতি সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন শহরের মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে তাঁর এত স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন এবং সকলের স্বীকার করেছেন যে, হাদীসশাস্ত্রে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। এ সম্পর্কে তাঁর জীবনী গ্রন্থে বহু চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। মাত্র এগার বছর বয়সে বুখারার বিখ্যাত মুহাদ্দিস দাখালী’র হাদীস বর্ণনা কালে যে ভুল সংশোধন করে দেন, হাদীস বিশারদগণের কাছে তা সত্যিই বিস্ময়কর । ইমাম বুখারি এক হাজারেরও বেশী সংখ্যক মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মাক্কী ইবন ইবরাহীম, আবূ আসিম, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, আলী ইবনুল মাদানী, ইসহাক ইবন রাহওয়াসহ, হুমাইদী , ইয়াহইয়া, উবায়দুল্লাহ ইবন মূসা, মুহাম্মদ ইবন সালাম আল বায়কান্দী ও মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ আল ফারইয়াবী (রঃ) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর উস্তাদদের অনেকেই তাবিঈদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবার তিনি তাঁর বয়ঃকনিষ্ঠদের থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) এর থেকে বুখারী শরীফ শ্রবণকারীর সংখ্যা নব্বই হাযারেরও অধিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর ছাত্রসংখ্যা বিপুল। তাঁদের মধ্যে ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, আবূ হাতিম আর রাযী (রঃ) প্রমুখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

    ইমাম বুখারী (রঃ) মহৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। দান-খয়রাত করা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।  উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি পিতার বিরাট ধন-সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর সবই গরীব দুঃখী ও হাদীস শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজে অতি সামান্য আহার করতেন। কখনোও কখনও দুই তিনটি বাদাম খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছেন। বহু বছর তরকারী ছাড়া রুটি খাওয়ার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

    ইমাম বুখারী (রঃ)-এর সততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। প্রসঙ্গত এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। আবূ হাফস (রঃ) একবার তাঁর কাছে বহু মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাঠান। এক ব্যাবসায়ী তা পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা দিয়ে খরিদ করতে চাইলে তিনি বললেনঃ তুমি আজ চলে যাও, আমি চিন্তা করে দেখি। পরের দিন সকালে আরেক দল ব্যাবসায়ী এসে দশ হাজার দিরহাম মুনাফা দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ গতরাতে আমি একদল ব্যাবসায়ীকে দিবার নিয়্যাত করে ফলেছি; কাজেই আমি আমার নিয়্যাতের খেলাফ করতে চাই না। পরে তিনি তা পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার দিরহামের মুনাফায় দিয়ে দিলেন। নিয়্যাত বা মনের সংকল্প রক্ষা করার জন্য পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা ছেড়ে দিতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমি জীবনে কোন দিন কারো গীবত শিকায়াত করিনি। তিনি রমযান মাসে পুরো তারাবীতে এক খতম এবং প্রতি তিন রাতে এক খতম কুরআন মজিদ তিলাওয়াত করতেন। একবার নফল সালাত আদায় কালে তাঁকে এক বিচ্ছু ষোল সতেরো বার দংশন করে, কিন্তু তিনি যে সুরা পাঠ করছিলেন তা সমাপ্ত না করে সালাত শেষ করেন নি। এভাবে তাকওয়া-পরহেযগারী, ইবাদত-বন্দেগী দান-খয়রাতের বহু ঘটনা তাঁর জীবনীকারগন বর্ণনা করেছেন, যা অসাধারণ ও বিস্ময়কর।

    ইমাম বুখারী (রঃ)-কে জীবনে বহু বিপদ ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। হিংসুকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেন। বুখারার গভর্নর তাঁর দুই পুত্রকে প্রাসাদে গিয়ে বিশেষভাবে হাদীস শিক্ষাদানের আদেশ করেন। এতে হাদীসের অবমাননা মনে করে ইমাম বুখারী (রঃ) তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ সুযোগে দরবারের কিছু সংখ্যক হিংসুকের চক্রান্তে তাঁকে শেষ বয়সে জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করতে হয়েছিল। এ সময় তিনি সমরকন্দবাসীর আহবানে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রোওয়ানা হন। পথিমধ্যে খরতাংগ পল্লীতে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পহেলা শাওয়াল শনিবার ২৫৬ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনভাবে তা নিবৃত করতে না পেরে কাটা দিয়ে ঘিরে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়। পরে জনৈক ওলিআল্লাহ আকিদা নষ্ট হওয়ার আশংকায় সে সুঘ্রান বন্ধ হওয়ার জন্য দু’আ করেন এবং তারপর তা বন্ধ হয়ে যায়।

    বুখারী শরীফ

    বুখারী শরীফের পূর্ণ নাম আল জামিউল মুসনাদুস সহীহুল মুখতাসারু মিন উমূরি রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়া আয়্যামিহী। হাদীসের প্রধান প্রধান বিষয়সমূহ সম্বলিত বলে একে ‘জামি’ বা পূর্ণাঙ্গ বলা হয়। কেবল মাত্রও সহীহ হাদীসে সন্নিবেশিত বলে ‘সহীহ’ এবং ‘মারফূ’ ‘মুত্তাসিল’ হাদীস বর্ণিত হওয়ার এর মুসনাদ নামকরণ করা হয়েছে।

    সকল মুহাদ্দিসের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, সমস্ত হাদীসগ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে এবং কুরআন মজীদের পরেই সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ গ্রন্থ। এক লাখ সহীহ ও দুই লাখ গায়ের সহীহ মোট তিন লাখ হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ)-এর মুখস্থ ছিল। এ ছাড়া তাঁর কাছে সংগৃহীত আরও তিন লাখ, মোট ছয় লাখ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে তিনি দীর্ঘ ষোল বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। বুখারী শরীফে সর্বমোট সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ‘তাকরার’ বা পুনরাবৃত্তি (যা বিশ্বের প্রয়োজনে করা হয়েছে) বাদ দিলে এই সংখ্যা মাত্র দুই হাজার পাঁচশত তের-তে দাঁড়ায়। মু’আল্লাক ও মুতাবা’আত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌছায় নয় হাজার বিরাশিতে। বুখারী শরীফের সর্বপ্রধান বর্ণনাকারী ফারাবরী (রঃ)-এর বর্ণনা অনুসারে বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফিয ইবন হাজার (রঃ) কতৃক     গননার সংখ্যা এখানে প্রদত্ত হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনাকারী ও গণনাকারীদের গণনায় এ সংখ্যার তারতম্য পরিলক্ষি ত হয়।

    উপরে বর্ণিত সুক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দু’রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক-একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। এরূপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের তুলনায় সারা মুসলিম জাহানে বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। জমহূর মুহাদ্দিসের বুখারী শরীফের বর্ণিত প্রতিটি হাদীস নিঃসন্দেহে সহীহ ও গ্রহণযোগ্য।

    বুখারী শরীফ সংকলনের জন্য ইমাম বুখারী (রঃ)-এর উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর বিখ্যাত ওস্তাদ ইসহাক ইবন রাহওয়ায়হ (রঃ) পরোক্ষভাবে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ তোমারদের মধ্যে কেউ কি এমন নেই, যে ‘ গায়ের সহীহ হাদীস’ থেকে ‘সহীহ হাদীস’ বাছাই করে একখানি গ্রন্থ সংকলন করতে পারে?

    ইমাম বুখারী (রঃ) একবার স্বপ্নে দেখেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর দেহ মুবারকের উপর মাছি এসে বসছে আর তিনি পাখা দিয়ে সেগুলকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তা’বীর বর্ণনাকারী আলিমগন এর ব্যাখ্যা দিলেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সহীহ হাদীসসমূহ  ‘গায়ের সহীহ’ হাদীস থেকে বাছাইয়ের কাজ স্বপ্ন দ্রষ্টা দ্বারা সম্পাদিত হবে। তখন থেকেই ইমাম বুখারীর মনে এরূপ একটি গ্রন্থ সংকলনের ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠে এবং তিনি দীর্ঘ ষোল বছরের অক্লান্ত সাধনার পর তা সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়। এই গ্রন্থ প্রনয়নে তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সহীহ হাদীসের একখানি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ রচনা করা এবং তাঁর সে উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে। এ গ্রন্থের হাদীস সন্নিবেশের পর তিনি চিন্তা করলেন যে, অধ্যায়নের সাথে সাথে যাতে লোক এর ভাবার্থ ও নির্দেশিত বিধানবলী সম্পর্কে অবহিত ও উপকৃত হতে পারে তজ্জন্য হাদীসসমূহ তিনি বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করে ‘তরজমাতুল বাব’ বা শিরোনাম কায়েম করেন। যেহেতু দীন-ই-ইসলামের শিক্ষা ব্যাপক ও বিস্তৃত, তাই এর বিধানাবলীর পরিসীমা নির্ধারণ করা দুষ্কর। পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী (রঃ) কর্তৃক সংকলিত হাদীসগুলোর সংখ্যা সীমিত। এই সীমিত সংখ্যক হাদীস দ্বারা দীন-ই ইসলামের ব্যাপক ও বিস্তৃতি শিক্ষার দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন দুষ্কর। তাই ইমাম বুখারী (রঃ) সংকলিত হাদীসগুলি দ্বারা ব্যাপক বিধানাবলীর দলীল কায়েম করতে গভীর জ্ঞ্যান ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে ইশারা বা ইঙ্গিতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। ফলে বুখারী শরীফ অধ্যয়নে তারজমাতুল বাব ও বর্ণিত হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান  করা আলিমদের দৃষ্টিতে একটি কঠিন সমস্যা ও প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
    বুখারী শরীফ প্রনয়নের পর থেকে আজ এই পর্যন্ত এই কঠিন সমস্যার সমাধান করতে মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আলিম সমাজকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। শিরোনামের এই রহস্য ভেদ করতে প্রত্যেকেই স্বীয় জ্ঞ্যান-বিবেকের তুণ থেকে তীর নিক্ষেপে কোন কসুর করেন নি, তবুও মুহাক্কিক আলিমদের ধারণায়, আজও কারো নিক্ষিপ্ত তীর থেকে তীর নিক্ষেপ কোন কসুর করেন নি, তবুও মুহাক্কিক আলিমদের ধারণায়, আজও কারো নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যস্থল ভেদে সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি সমর্থ হয় নি। এজন্য বলা হয়ে থাকে ‘ফিকহুল বুখারী ফী তারাজিমিহী’ অর্থাৎ ইমাম বুখারী (রঃ)-এর জ্ঞ্যান-গরিমা ও বুদ্ধি-চাতুর্য তাঁর গ্রন্থের তরজমা বা শিরোনামের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। পরবর্তীকালে মহিষীগণ এই লুক্কায়িত রত্ন যথাযথ উদ্ধারের সর্বশক্তি ও শ্রম ব্যায় করেও পূর্ণভাবে সফলকাম হতে ব্যর্থ হয়েছেন।

    বুখারী শরীফ সংকলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল দেশের সকল শ্রেণীর মুসলিম মনীষীগণ যেভাবে এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছেন আল্লাহ্‌র কালাম কুরআন মজীদ ছাড়া আর কোন গ্রন্থের প্রতি এরূপ ঝুঁকে পড়েন নি। একমাত্র ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে নব্বই হাজারেরও অধিক সংখ্যক লোক এ গ্রন্থের হাদীস শ্রবণ করেছে। তারপর প্রত্যেক যুগেই অসংখ্য হাদীস শিক্ষার্থী এ অধ্যয়ন করে আসছে। এ গ্রন্থের ভাষ্য পুস্তকের সংখ্যাও অগণিত। এ সব এর মধ্যে হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র) (জ. ৭৬২ হি. মৃ. ৮৫৫ হি. )-এর ‘উমদাতুল-কারী ও আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমদ কাসতালানী (রঃ) (জ. ৮৫১ হি. মৃ.  ৯২৩ হি. )-এর ‘ইরশাদুস-সারী’ সমধিক প্রসিদ্ধ। এঁরা তিনজনই মিসরের অধিবাসী ছিলেন। এ ছাড়া বর্তমান যুগে সহীহ বুখারী অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হিসেবে মওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রঃ) ( জ. ১২৪৪ হি. মৃ. ১৩২৩ হি.) কৃত ‘লামেউদ দারারী’ এবং মওলানা সৈয়দ আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি (জ. ১২৯২ হি. মৃ. ১৩৫২ হি. ) কৃত ‘ফয়যুল বারী’ বিশেষভাবে সমাদৃত। ইমাম বুখারী (রঃ) ও তাঁর সংকলিত বুখারী শরীফের যে উচ্ছাসিত প্রশংসা ও এর উপরে যে ব্যাপক ‘ইলমী চর্চা হয়েছে তাঁর সহস্র ভাগের এক ভাগ বর্ণনা করাও এ স্বল্প পরিসরে সম্ভবপর নয়।

    মুসলিম জাহানের সর্বত্র সমাদৃত এর পবিত্র হাদীশগ্রন্থ থেকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক যাতে সরাসরি উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ সংক্ষিপ্ত ভূমিকা সহ সরল বঙ্গানুবাদ পেশ করা হল। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ থেকে আমাদের উপকৃত হওয়ার তওফীক দান করুন। আমীন।

    অনুবাদ সম্পর্কে কিছু জ্ঞ্যাতব্যঃ

    ১। সনদের ক্ষেত্রে প্রথম রাবী এবং শেষে সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন মুহাম্মদ ইবন মুসান্না (রঃ)-- আবূ হুরায়রা (রঃ) থেকে। -----
    ২। সনদের যেখানে তাহবীল রয়েছে সেখানে প্রথম রাবীর সাথেই এই তাহবীলকৃত রাবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
    ৩। আরবী, ফার্সী, উর্দু বানানের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত প্রতিবর্ণায়ন নির্দেশিকায় অনুমোদিত রূপটি যথাসম্ভভ গ্রহণ করা হয়েছে।
    ৪। সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে (সঃ), আলায়হিস সালাম-এর ক্ষেত্রে (আঃ), রাদীআল্লাহু তা’আলা আনহু, আনহুম ও আনহা-র ক্ষেত্রে (রঃ) এবং রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আলায়হিম, আলায়হা-এর ক্ষেত্রে (রঃ) পাঠ সংকেত গ্রহণ করা হয়েছে।
    ৫। একাধিক রাবীর নাম একত্রে এলে সর্বশেষ নামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্মানসূচক পাঠ সংকেত উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন- আনাস, আব্বাস, আবূ হুরায়রা (রঃ) ।
    ৬। কুরআন মজীদের আয়াতের ক্ষেত্রে প্রথম সূরা নম্বর, পরে আয়াত নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। জেমন-২: ১৩৮ অর্থাৎ সূরা বাকারার ১৩৮ নং আয়াত।

    পরিশেষে সম্পাদনা পরিষদের পক্ষ থেকে ধর্ম মন্ত্রনালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে আন্তরিক মুবারকবাদ জ্জাপন করেছি যে, তারা এমন একটি মহান কাজের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এই মহাপ্রয়াসের সঙ্গে জড়িত সকল পর্যায়ের আলিম-উলামা-সুধী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের জন্য দু’আ করি, তিনি যেন এই ওয়াসীলায় তাঁদের ও আমাদের সকল গুনাহ-খাতা মাফ করে দেন এবং নেক জাযা দেন।

    - সমাপ্ত -