• Latest post

    আশুরা মুহাররমে প্রচলিত বিদআতসমুহ ও বর্জনীয় আমল,

    আশূরার বিদ‘আত সমূহ :

    আশূরায়ে মুহাররম আমাদের দেশে শোকের মাস হিসাবে আগমন করে। শী‘আ, সুন্নী সকলে মিলে অগণিত শির্ক ও বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। কোটি কোটি টাকার অপচয় হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে। সরকারী ছুটি ঘোষিত হয় ও সরকারীভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়। হোসায়েনের ভুয়া কবর তৈরী করে রাস্তায় তা‘যিয়া বা শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভুয়া কবরে হোসায়েনের রূহ হাযির হয় ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। মিথ্যা শোক প্রদর্শন করে বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে মাতম করা হয়। রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রং-বেরং সাজে সাজানো হয়। লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া হয়। হোসায়েনের নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে ‘বরকতের পিঠা’ বলে বেশী দামে বিক্রি করা হয়। হোসায়েনের নামে ‘মোরগ’ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ ‘বরকতের মোরগ’ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোশাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করা হয় ইত্যাদি। এমনকি  অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিবাহ-শাদী করা অন্যায় মনে করে থাকেন। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুর  দুধ পান করানোকেও অন্যায় ভাবেন।

    ওদিকে উগ্র শী‘আরা কোন কোন ‘ইমাম বাড়া’তে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা মতে আয়েশা (রাঃ)-এর পরামর্শক্রমেই আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অসুখের সময় জামা‘আতে ইমামতি করেছিলেন ও পরে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেকারণ আলী (রাঃ) খলীফা হ’তে পারেননি (নাঊযুবিল্লাহ)। হযরত ওমর, হযরত ওছমান, হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ), হযরত মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) প্রমুখ জলীলুল ক্বদর ছাহাবীকে এ সময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়।

    এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝাতে চেষ্টা করে যে, আশূরায়ে মুহাররমের মূল বিষয় হ’ল শাহাদাতে হোসায়েন (রাঃ) বা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। চেষ্টা করা হয় এটাকে ‘হক ও বাতিলের’ লড়াই হিসাবে প্রমাণ করতে। চেষ্টা করা হয় হুসায়েনকে ‘মা‘ছূম’ ও ইয়াযীদকে ‘মাল‘ঊন’ প্রমাণ করতে। অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।

    আশূরা উপলক্ষ্যে প্রচলিত উপরোক্ত বিদ‘আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব এবং অশুদ্ধ আক্বীদা সমূহের কোন প্রমাণ ছাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তা‘যিয়ার নামে ভুয়া কবর যেয়ারত করাও তেমনি মূর্তিপূজার শামিল। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ زَارَ قَبْرًا بِلاَ مَقْبُوْرٍ كَأَنَّمَا عَبَدَ الصَّنَمَ، رواه البيهقى والطبرانى ‘যে ব্যক্তি লাশ ছাড়াই ভুয়া কবর যেয়ারত করল, সে যেন মূর্তিকে পূজা করল’।[10]  

    এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোক মিছিল ইসলামী শরী‘আতের পরিপন্থী। কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতি সেŠধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন ইত্যাদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।

    অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ হ’ল ছাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيْفَهُ ‘তোমরা আমার ছাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে,) তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ অর্থাৎ সিকি ছা‘ বা তার অর্ধেক পরিমাণ (যব খরচ)-এর সমান ছওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না’।[11]

    শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ  ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি শোকে নিজ মুখে মারে, কাপড় ছিঁড়ে ও জাহেলী যুগের ন্যায় মাতম করে’।[12]

    অন্য হাদীছে এসেছে যে, ‘আমি ঐ ব্যক্তি হ’তে দায়িত্ব মুক্ত, যে ব্যক্তি শোকে মাথা মুন্ডন করে, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদে ও কাপড় ছিঁড়ে’।[13]

    অধিকন্তু ঐ সব শোক সভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য মিটিয়ে দিয়ে হোসায়েন কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে শিরক।

    বিদ‘আতের সূচনা :

    আববাসীয় খলীফা মুত্বী‘ বিন মুক্বতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩হিঃ/৯৪৬-৯৭৪ খৃঃ) তাঁর কট্টর শী‘আ আমীর আহমাদ বিন বূইয়া দায়লামী ওরফে ‘মুইযযুদ্দৌলা’ ৩৫১ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখে বাগদাদে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের তারিখকে তাদের হিসাবে খুশীর দিন মনে করে ‘ঈদের দিন’ (عيد غدير خم) হিসাবে ঘোষণা করেন। শী‘আদের নিকটে এই দিনটি পরবর্তীতে ঈদুল আযহার চাইতেও গুরুত্ব পায়। অতঃপর ৩৫২ হিজরীর শুরুতে ১০ই মুহাররমকে তিনি ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন ও মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহর ও গ্রামের সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শী‘আরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা চুপ হয়ে যান। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারি করা হলে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। ফলে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অশান্তির সৃষ্টি হয়।[14]

    বলা বাহুল্য বাগদাদের সুন্নী খলীফার শক্তিশালী শী‘আ আমীর মুইয্যুদ্দৌলার চালু করা এই বিদ‘আতী রীতির ফলশ্রুতিতে আজও ইরাক, ইরান, পাকিস্তান ও ভারত সহ বিভিন্ন মুসলিম এলাকায় আশূরার দিন চলছে শী‘আ-সুন্নী পরস্পরে গোলযোগ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

    হক ও বাতিলের লড়াই?

    কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা যেকোন নিরপেক্ষ মুমিনের হৃদয়কে ব্যথিত করে। কিন্তু তাই বলে এটাকে হক ও বাতিলের লড়াই বলে আখ্যায়িত করা চলে কি? যদি তাই করতে হয়, তবে হোসায়েন (রাঃ)-কে কূফায় যেতে বারবার নিষেধকারী এবং ইয়াযীদের (২৭-৬৪হিঃ) হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণকারী বাকী সকল ছাহাবীকে আমরা কি বলব? যাঁরা হোসায়েন (রাঃ) নিহত হওয়ার পরেও কোনরূপ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরে ঐ সময়ে জীবিত প্রায় ৬০ জন ছাহাবীসহ তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পরবর্তী খলীফা হিসাবে ইয়াযীদের হাতে বায়‘আত করেন।[15]

    কেবলমাত্র মদীনার চারজন ছাহাবী বায়‘আত নিতে বাকী ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ও হুসায়েন বিন আলী (রাঃ)। প্রথমোক্ত দু’জন  পরে বায়‘আত করেন। শেষোক্ত দু’জন গড়িমসি করলে হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, إِتَّقِيَا اللهَ وَلاَ تَفَرَّقَا بَيْنَ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِيْنَ ‘আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন! মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না’।[16]

    হুসায়েন (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) দু’জনেই মদীনা থেকে মক্কায় চলে যান। সেখানে কূফা থেকে দলে দলে লোক এসে হুসায়েন (রাঃ)-কে কূফায় যেয়ে তাদের আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করতে অনুরোধ করতে থাকে। কূফার নেতাদের কাছ থেকে ১৫০টি লিখিত অনুরোধ পত্র তাঁর নিকটে পৌঁছে।[17] তিনি স্বীয় চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ)-কে কূফায় প্রেরণ করেন। সেখানে ১২ থেকে ১৮ হাযার লোক হুসায়েনের পক্ষে মুসলিম-এর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করে। মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ) সরল মনে হুসায়েন (রাঃ)-কে কূফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র পাঠান। সেই পত্র পেয়ে হুসায়েন (রাঃ) হজ্জের একদিন পূর্বে সপরিবারে মক্কা হ’তে কূফা অভিমুখে রওয়ানা হন। হুসায়েন (রাঃ)-এর আগমনের খবর জানতে পেরে কূফার গভর্ণর নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) জনগণকে ডেকে বিশৃংখলা না ঘটাতে উপদেশ দেন। কোনরূপ কঠোরতা প্রয়োগ করা হ’তে তিনি বিরত থাকেন। ফলে কুচক্রীদের পরামর্শে তিনি পদচ্যুত হন ও বছরার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে একই সাথে কূফার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি প্রথমেই মুসলিম বিন আক্বীলকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন। তখন সকল কূফাবাসী হুসায়েন (রাঃ)-এর পক্ষ ত্যাগ করে। ইতিমধ্যে হুসায়েন (রাঃ) কূফার সন্নিকটে পৌঁছে যান। ইবনে যিয়াদ প্রেরিত সেনাপতি তখন তাঁর গতিরোধ করে। সমস্ত ঘটনা বুঝতে পেরে হযরত হোসায়েন (রাঃ) তখন ইবনে যিয়াদের নিকটে নিম্নোক্ত তিনটি প্রস্তাবের যেকোন একটি মেনে নেওয়ার জন্য সন্ধি প্রস্তাব পাঠান। إِخْتَرْ مِنِّيْ إِحْدَى ثَلاَثٍ : إِمَّا أَنْ أُلْحِقَ بِثِغَرٍ مِنَ الثُّغُوْرِ وَإِمَّا أَنْ أَرْجِعْ إِلَى الْمَدِيْنَةِ وَإِمَّا أَنْ أَضَعْ يَدِىْ فِىْ يَدِ يَزِيْدَ بْنِ مُعَاوِيَةَ ১- আমাকে সীমান্তের কোন এক স্থানে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হৌক। ২- মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হৌক। ৩- আমাকে ইয়াযীদের হাতে হাত রেখে বায়‘আত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হউক।[18]

    সেনাপতি আমর বিন সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ উক্ত প্রস্তাব সমূহ মেনে নিলেও দুষ্টমতি ইবনে যিয়াদ তা নাকচ করে দেন ও প্রথমে ইয়াযীদের পক্ষে তার হাতে বায়‘আত করার নির্দেশ পাঠান। হুসায়েন (রাঃ) সঙ্গত কারণেই তা প্রত্যাখ্যান করেন ও সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ফলে তিনি সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন)।

    প্রত্যক্ষদর্শী জীবিত পুরুষ সদস্য হযরত আলী বিন হুসায়েন ওরফে ‘যয়নুল আবেদীন’ (রাঃ)-এর পুত্র শী‘আদের সম্মানিত ইমাম আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ বিন আলী বিন হুসায়েন (রাঃ) ওরফে ইমাম বাক্বের (রাঃ)-এর সাক্ষ্য ঠিক অনুরূপ, যা হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী স্বীয় গ্রন্থ ‘তাহযীবুত তাহযীব’-য়ে (২য় খন্ড পৃঃ ৩০১-৩০৫) এবং হাফেয ইবনু কাছীর স্বীয় ‘আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’-তে (৮ম খন্ড পৃঃ ১৯৮-২০০) ত্বাবারীর বরাতে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বাক্বের বলেন, যখন বিরোধী পক্ষের নিক্ষিপ্ত একটি তীর এসে হুসায়েনের কোলে আশ্রিত শিশুপুত্রের বক্ষ ভেদ করে, তখন তিনি বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসীদের দায়ী করে বলেন, اَللَّهُمَّ احْكُمْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمٍ دَعَوْنَا لِيَنْصُرُوْنَا ثُمَّ يَقْتُلُوْنَنَا ‘হে আল্লাহ! তুমি ফায়ছালা কর আমাদের মধ্যে এবং ঐ কওমের মধ্যে, যারা আমাদেরকে সাহায্যের নাম করে ডেকে এনে হত্যা করছে’।[19]

    উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, কারবালার ঘটনাটি ছিল নিতান্তই রাজনৈতিক মতবিরোধের একটি দুঃখজনক পরিণতি। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য মূলতঃ দায়ী ছিল বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসীরা ও নিষ্ঠুর গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ নিজে। কেননা ইয়াযীদ কেবলমাত্র হুসায়েনের আনুগত্য চেয়েছিলেন, তাঁর খুন চাননি। হুসায়েন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। ইয়াযীদ স্বীয় পিতার অছিয়ত অনুযায়ী হুসায়েনকে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন। ইতিপূর্বে হুসায়েন (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন যোবায়ের (রাঃ) অন্যান্য ছাহাবীগণের সাথে ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে ৪৯ মতান্তরে ৫১ হিজরীতে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছেন।

    যখন হুসায়েন (রাঃ)-এর ছিন্ন মস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হয়, তখন তিনি কেঁদে উঠে বলেছিলেন, لَعَنَ اللهُ ابْنَ مَرْجَانَةَ يَعْنِىْ عُبَيْدَ اللهِ بْنَ زِيَادٍ، أَمَا وَاللهِ لَوْ كَانَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْحُسَيْنِ رَحِمٌ لَمَا قَتَلَهُ وَقَالَ : قَدْ كُنْتُ أَرْضَى مِنْ طَاعَةِ أَهْلِ الْعِرَاقِ بِدُوْنِ قَتْلِ الْحُسَيْنِ (مختصر منهاج السنة 1/350)- ‘ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপরে আল্লাহ পাক লা‘নত করুন! আল্লাহর কসম যদি হুসায়েনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহলে সে কিছুতেই ওঁকে হত্যা করত না’। তিনি আরও বলেন যে, ‘হুসায়েনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম’।[20]

    অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, ইয়াযীদ আরও বলেন যে, ‘ইবনে যিয়াদের উপরে আল্লাহ লা‘নত করুন! সে হুসায়েনকে কোনঠাসা ও বাধ্য করেছে। তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন অথবা আমার নিকটে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সবকিছু প্রত্যাখ্যান করে ও তাঁকে হত্যা করে। এর ফলে সে আমাকে মুসলমানদের বিদ্বেষের শিকারে পরিণত করেছে। তাদের হৃদয়ে আমার বিরুদ্ধে শত্রুতার বীজ বপন করেছে। ভাল ও মন্দ সকল প্রকারের লোক হুসায়েন হত্যার মহা অপরাধে আমাকে দায়ী করবে ও আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে। হায়! আমার কি হবে ও ইবনু মারজানার (ইবনে যিয়াদের) কি হবে! আল্লাহ তাকে মন্দ করুন ও তার উপরে গযব নাযিল করুন’।[21]

    হুসায়েন পরিবারের স্ত্রী-কন্যা ও শিশুগণ ইয়াযীদের প্রাসাদে প্রবেশ করলে প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইয়াযীদ তাঁদেরকে বিপুলভাবে সম্মানিত করেন ও মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সসম্মানে মদীনায় প্রেরণ করেন।[22]

    যে তিন দিন হুসায়েন পরিবার ইয়াযীদের প্রাসাদে ছিলেন, সে তিন দিন সকাল ও সন্ধ্যায় হুসায়েনের দুই ছেলে আলী (ওরফে ‘যয়নুল আবেদীন’) এবং ওমর বিন হুসায়েনকে সাথে নিয়ে ইয়াযীদ খানাপিনা করতেন ও আদর করতেন’।[23]

    ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়াহ-র চরিত্র সম্পর্কে হুসায়েন (রাঃ)-এর অন্যতম বৈমাত্রেয় ছোট ভাই ও শী‘আদের খ্যাতনামা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিইয়াহ (রাঃ) বলেন, مَا رَأَيْتُ مِنْهُ مَا تَذْكُرُونَ، وَقَدْ حَضَرْتُهُ وَأَقَمْتُ عِنْدَهُ فَرَأَيْتُهُ مُوَاظِبًا عَلَى الصَّلَاةِ مُتَحَرِّيًا لِلْخَيْرِ يَسْأَلُ عَنِ الْفِقْهِ مُلَازِمًا لِلسُّنَّةِ ‘আমি তাঁর মধ্যে ঐ সব বিষয় দেখিনি, যেসবের কথা তোমরা বলছ। অথচ আমি তাঁর নিকটে হাযির থেকেছি ও অবস্থান করেছি এবং তাঁকে নিয়মিতভাবে ছালাতে অভ্যস্ত ও কল্যাণের আকাংখী দেখেছি। তিনি ‘ফিক্বহ’ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তিনি সুন্নাতের পাবন্দ’।[24]

    সমুদ্র অভিযান এবং রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِى يَغْزُونَ الْبَحْرَ قَدْ أَوْجَبُوا... وَقَالَ : أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِى يَغْزُونَ مَدِينَةَ قَيْصَرَ مَغْفُورٌ لَهُمْ... رواه البخارىُّ عن أم حرام (رض)- ‘আমার উম্মতের ১ম সেনাবাহিনী যারা সমুদ্র অভিযানে অংশ গ্রহণ করবে, তারা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিবে’। ...অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের ১ম সেনাবাহিনী যারা রোমকদের রাজধানীতে অভিযান করবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে’।[25]

    মুহাল্লাব বলেন, এই হাদীছের মধ্যে হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তাঁর পুত্র ইয়াযীদ-এর মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) সিরিয়ার গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে মু‘আবিয়া (রাঃ) ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে ১ম সমুদ্র অভিযান করেন। অতঃপর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত কালে (৪১-৬০হিঃ) ৫১ হিজরী মতান্তরে ৪৯ হিজরী সনে ইয়াযীদের নেতৃত্বে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদ্দেশ্যে ১ম যুদ্ধাভিযান প্রেরিত হয়। উক্ত নৌযুদ্ধে ছাহাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) মারা যান ও কনস্টান্টিনোপলের প্রধান ফটকের মুখে তাঁকে দাফন করার অছিয়ত করেন। অতঃপর সেভাবেই তাঁকে দাফন করা হয়। কথিত আছে যে, রোমকরা পরে ঐ কবরের অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করত’।[26]

    ২৭ হিজরীর ১ম যুদ্ধে মু‘আবিয়া (রাঃ) রোমকদের ‘ক্বাবরাছ’ (قبرص) জয় করেন। অতঃপর ৫১ হিজরীতে রোমকদের রাজধানী জয় করে ফিরে এসে ইয়াযীদ হজ্জ ব্রত পালন করেন।[27] ইবনু কাছীর বলেন, ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে পরিচালিত উক্ত অভিযানে স্বয়ং হুসায়েন (রাঃ) অংশ গ্রহণ করেন।[28] এতদ্ব্যতীত যোগদান করেছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আবু আইয়ূব আনছারী প্রমুখ খ্যাতনামা ছাহাবীগণ।[29]

    মৃত্যুকালে মু‘আবিয়া (রাঃ) ইয়াযীদকে হুসায়েন (রাঃ) সম্পর্কে অছিয়ত করে বলেছিলেন, فَإِنْ خَرَجَ عَلَيْكَ فَظَفَرْتَ بِهِ فَاصْفَحْ عَنْهُ فَإِنَّ لَهُ رَحِمًا مَا مِثْلَهُ وَحَقًّا عَظِيْمًا- ‘যদি তিনি তোমার বিরুদ্ধে উত্থান করেন ও তুমি তাঁর উপরে বিজয়ী হও, তাহ’লে তুমি তাঁকে ক্ষমা করবে। কেননা তাঁর রয়েছে রক্ত সম্পর্ক, যা অতুলনীয় এবং রয়েছে মহান অধিকার’।[30] ইবনু আসাকির স্বীয় ‘তারীখে’ ইয়াযীদ-এর মন্দ স্বভাবের বর্ণনায় যে সব উদ্ধৃতি পেশ করেছেন, সে সম্পর্কে ইবনু কাছীর বলেন, وَقَدْ أَوْرَدَ ابْنُ عَسَاكِرَ أَحَادِيثَ فِي ذَمِّ يَزِيدَ بْنِ مُعَاوِيَةَ كُلُّهَا مَوْضُوعَةٌ لاَ يَصِحُّ شَيْءٌ مِنْهَا ‘ইয়াযীদের মন্দ স্বভাব সম্পর্কে ইবনু আসাকির বর্ণিত উক্তি সমূহের সবগুলিই জাল। যার একটিও সত্য নয়।[31]

    মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যু কালে ইয়াযীদের শেষ কথা ছিল, اَللَّهُمَّ لاَ تُؤَاخِذْنِي بِمَا لَمْ أُحِبُّهُ، وَلَمْ أُرِدْهُ، وَاحْكُمْ بَيْنِي وَبَيْنَ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ زِيَادٍ ‘হে আল্লাহ! আমাকে পাকড়াও করো না ঐ বিষয়ে যা আমি চাইনি এবং আমি প্রতিরোধও করিনি এবং আপনি আমার ও ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের মধ্যে ফায়ছালা করুন’।[32]


    ইযায়ীদ স্বীয় আংটিতে খোদাই করেছিলেন, آمَنْتُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ ‘আমি ঈমান এনেছি আল্লাহর উপরে যিনি মহান’।[33]
    10]. বায়হাক্বী, ত্বাবারাণী। গৃহীত : আওলাদ হাসান কান্নৌজী ‘রিসালাতু তাম্বীহিয যা-ল্লীন’ বরাতে : ছালাহুদ্দীন ইউসুফ ‘মাহে মুহাররম ও মউজূদাহ মুসলমান’ (লাহোর : ১৪০৬ হিঃ) পৃঃ ১৫।
    [11]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৮ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭৫৪।
    [12]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭২৫ ‘জানাযা’ অধ্যায়।
    [13]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭২৬।
    [14]. ইবনুল আছীর, তারীখ ৮/১৮৪ পৃঃ; গৃহীত : মাহে মুহাররম পৃঃ ১৮-২০।
    [15]. ইবনু রাজাব, যায়লু তাবাক্বা-তিন হানাবিলাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৪ বর্ণনা : আব্দুল গণী  মাক্বদেসী (৬০-৭০০ হিঃ)।
    [16]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি), ৮ম খন্ড পৃঃ ১৫০।
    [17]. আল-বিদায়াহ ৮/১৫৪।
    [18]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ২/২৫২; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৮/১৭১।
    [19]. ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/৩০৪ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৮/১৯৯ পৃঃ। দুঃখ লাগে এই ভেবে যে, যারা প্রতারণা করে ডেকে এনে হযরত হুসায়েন (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল, সেই কূফাবাসী ইরাকীরাই বড় হুসায়েন প্রেমিক সেজে ঘটা করে শোক পালন ও তা‘যিয়া মিছিল করছে। আর সুন্নীদের গালি দিচ্ছে।-লেখক।
    [20]. ইবনু তায়মিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ (রিয়ায : মাকতাবাতুল কাওছার ১ম সংস্করণ ১৪১১/১৯৯১) ১ম খন্ড পৃঃ ৩৫০; একই মর্মে বর্ণনা এসেছে, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৭৩।
    [21]. আল-বিদায়াহ ৮ম খন্ড পৃঃ ২৩৫।
    [22]. মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ১ম খন্ড পৃঃ ৩৫০।
    [23]. আল-বিদায়াহ ৮ম খন্ড পৃঃ ১৯৭।
    [24]. আল-বিদায়াহ ৮ম খন্ড পৃঃ ২৩৬।
    [25]. বুখারী হা/২৯২৪, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘রোমকদের বিরুদ্ধে লড়াই’ অনুচ্ছেদ।
    [26]. ফৎহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড পৃঃ ১২০-২১।
    [27]. আল-বিদায়াহ ৮/২৩২ পৃঃ।
    [28]. আল-বিদায়াহ ৮/১৫৩ পৃঃ।
    [29]. ইবনুল আছীর, ‘তারীখ’ ৩/২২৭ পৃঃ-এর বরাতে ‘মাহে মুহাররম’ পৃঃ ৬৩। 
    [30]. তারীখে ইবনে খলদুন (বৈরুত : ১৩৯১/১৯৭১) ৩য় খন্ড পৃঃ ১৮।
    [31]. আল-বিদায়াহ ৮/২৩৪ পৃঃ।
    [32]. আল-বিদায়াহ ৮/২৩৯ পৃঃ।
    [33]. প্রাগুক্ত।
    আশুরা মুহাররমে করনীয় ও বর্জনীয়,
    আশুরা মুহাররম,